৬১৫ হিজরীতে (১২৬৬-৬৭ খ্রি) চেঙ্গিস খান ইসলামী দেশসমূহের উদ্দেশে অভিযান পরিচালনা করেন । তিনি আনযারের নিকটবর্তী হয়ে তার তিন পুত্র ভূর্জী খান, উকতাই খান ও চুগতাই খানকে আনযার অবরোধে মোতায়েন করেন। তারপর আলাক নূইয়া ও মননকৃ বূকাকে এক এক বাহিনী দিয়ে খোজান্দ ও নাবাকত অভিমুখে প্রেরণ করেন এবং আপন কনিষ্ঠ পুত্র তূলীখানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি স্বয়ং বুখারা অভিমুখে রওয়ানা হন। মঙ্গোলদের এই হামলার খবর পেয়ে খাওয়ারিযম শাহ ষাট হাজার সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী আনযারের দিকে এবং ত্রিশ হাজার অশ্বারোহীর এক বাহিনী বুখারার দিকে প্রেরণ করেন। তারপর দুই লক্ষ দশ হাজার সৈন্যের এক বাহিনীকে সমরকন্দের হিফাযতের জন্য এবং ষাট হাজার লোককে বুরুজ ও দুর্গ মেরামতের জন্য মোতায়েন করে স্বয়ং সমরকন্দ থেকে খুরাসানের উদ্দেশে রওয়ানা হন।
খাওয়ারিজম শাহ সমরকন্দ থেকে বলখে গিয়ে পৌঁছেন এবং আপন পরিবার-পরিজন ও ধনসম্পদ মাযেন্দানে পাঠিয়ে দেন। বলখে পৌঁছে তিনি মঙ্গোলদের মুকাবিলায় কি কৌশল অবলম্বন করতে হবে সে সম্পর্কে আপন আমীর-উমারা ও অধিনায়কদের সাথে পরামর্শ করেন। খাওয়ারিজম শাহের ছিল সাত পুত্র। তন্মধ্যে জালালুদ্দীন নামক পুত্র পিতাকে ভীতিগ্রস্ত অবস্থায় দেখে বললঃ আপনি যদি ইরাকের দিকে যেতে চান তাহলে সেনাবাহিনীর অধিনায়কত্ব আমার হাতে অৰ্পণ করে নিশ্চিন্তে যেতে পারেন। আল্লাহ্ চাহে তো আমি শত্রুদের উপর হামলা চালাবো এবং জাইন নদীর ওপারে গিয়ে আমার তাঁবু স্থাপন করব। মাওরাউন না আমার দায়িত্বে অর্পণ করুন এবং আপনি শুধু ইরাক ও খুরাসান সামলান।
কিন্তু খাওয়ারিজম শাহ তার পুত্রের একথা পছন্দ করলেন না। তিনি বলখ থেকে হিরাত অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেলেন । ইতিমধ্যে সংবাদ এসে পৌঁছল যে, মঙ্গোলরা বুখারা জয় করে সেখানকার সমগ্র অধিবাসীকে হত্যা করে ফেলেছে।
এ সংবাদ শুনে খাওয়ারিজম শাহ আরো বেশি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং হিরাত থেকে নিশাপুর চলে যান। এদিকে খাওয়ারিজম শাহ নিশাপুরে আব্রাম-আয়েশে লিপ্ত থাকেন । ৬১৭ হিজরীর সফর (১২২০ খ্রি মে) মাসে চেঙ্গিস খানের জনৈক অধিনায়ক ত্রিশ হাজার সৈন্য নিয়ে জাইয়ূন নদী অতিক্রম করেন। এই সংবাদ শুনে খাওয়ারিজম শাহ অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েন এবং পরিবার-পরিজন ও ধনভাণ্ডার কারূন দুর্গে পাঠিয়ে দিয়ে স্বাধীন নিশাপুর থেকে ইসফারাইনে চলে যান।
শেষ পর্যন্ত খাওয়ারিজম শাহ একটি দ্বীপে গিয়ে আশ্রয় নেন। সেখানে তার কাছে সংবাদ পৌঁছে যে, মঙ্গোলরা কারূন দুর্গ জয় করে তার সমগ্র ধনভাণ্ডার এবং পরিবার-পরিজনের উপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। এই সংবাদ শুনে তিনি এতই দুঃখিত ও মর্মাহত হন যে, সেই দুঃখেই তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। তিনি যে পোশাক পরে মৃত্যুবরণ করেছিলেন সেই পোশাকেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। কোন কাফন তার ভাগ্যে জুটেনি। বিভিন্ন প্রদেশের শাসন ক্ষমতায় নিয়োজিত খাওয়ারিজম শাহের পুত্ররা মঙ্গোলদের হাতে নিহত হন। শুধু একজন পুত্র অবশিষ্ট থাকেন। তার নাম ছিল জালালুদ্দীন। তিনি তাঁর ভাইদের মধ্যে অধিকতর বিচক্ষণ বিদ্যোৎসাহী ও বীর পুরুষ ছিলেন।
এই সময়ে বুখারা, সমরকন্দ প্রভৃতি অঞ্চল জয় করে মঙ্গোলরা সমগ্র খুরাসানে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত ৬১৭ হিজরীর রবিউল আউয়ালের শেষ দিকে (১২২০ খ্রি জুনের প্রথম দিকে) চেঙ্গিস খান জাইন নদী অতিক্রম করে বলখ ও হিরাতে পাইকারী হত্যাকাণ্ড চালান। যখন খাওয়ারিজম শাহের পরিবার-পরিজন বন্দী হয়ে চেঙ্গিস খানের সামনে নীত হন তখন ঐ পাষাণ ব্যক্তিটি স্ত্রীলোক এবং শিশুদের প্রতিও কোনরূপ দয়া প্রদর্শন করেননি
সুলতান জালালুদ্দীন এক বাহিনী গঠন করে চেঙ্গিস খানের মুকাবিলায় উদ্যত হয়েছেন ঠিক এমনি মুহূর্তে বাহিনীর কিছু সংখ্যক অধিনায়ক ধোঁকা দিয়ে মঙ্গোলদের সাথে গিয়ে মিলিত হয়। ফলে জালালুদ্দীনের কাছে শুধু সাতশ লোক থাকে । ওদেরকে নিয়েই লড়তে লড়তে সুলতান জালালুদ্দীন সিন্ধু নদের উপকূল অভিমুখে রওয়ানা হন। চেঙ্গিস খানও আপন বিরাট বাহিনী নিয়ে সেখানে এসে পৌঁছেন।
জালালুদ্দীন সিন্ধুনদকে পটভূমিতে রেখে মঙ্গোল বাহিনীর মুকাবিলা করেন। মঙ্গোলরা ধনুক আকারে ঘেরাও করে জালালুদ্দীনের উপর হামলা চালায়। এতদসত্ত্বেও জালালুদ্দীন অত্যন্ত বীরত্বের সাথে মঙ্গোলদের মুকাবিলা করেন এবং তাদেরকে বিপর্যস্ত করে তোলেন। সুলতান জালালুদ্দীন যখন বিপুল বিক্রমে মঙ্গোলদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তেন তখন তারা অনেক দূর পিছনে হটে যেতো।
কিন্তু প্রচুর জনবল থাকায় তারা পুনরায় এগিয়ে এসে হামলা করতো। নিজের জনবলের স্বল্পতার কারণে এই যুদ্ধে সুলতান জালালুদ্দীন জয়ী হতে পারেননি সত্য, তবে এর মাধ্যমে তাঁর বীরত্ব, তেজস্বিতা ও দুঃসাহসিকতার যে ছবি চেঙ্গিস খানের চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল তা বোধ করি তিনি কোনদিন বিস্মৃত হতে পারেননি। জালালুদ্দীন খাওয়ারিজম শাহ বাহিনীর এই সাতশ বীর যোদ্ধার মধ্যে মাত্র একশ জনের মত যখন অবশিষ্ট থাকে তখন জালালুদ্দীন আপন দেহ থেকে বর্ম খুলে দূরে নিক্ষেপ করেন এবং নিজের মুকুটটি হাতে নিয়ে সিন্ধু নদে ঘোড়া ছুটিয়ে দেন।
চেঙ্গিস খান অপর পাড়ে দাঁড়িয়ে বিস্ময়াবিষ্ট চিত্তে জালালুদ্দীনের এসব ব্যাপার লক্ষ্য করেন। এক সময় তিনি তার সকল পুত্র এবং অধিনায়কদেরকে, যারা সেখানে তার সাথে ছিল, সম্মুখে ডেকে এনে বলেন- আমি আজ পর্যন্ত এমন একজন বাহাদুর ও দুঃসাহসী ব্যক্তি দেখিনি। তাঁর সঙ্গীরাও তাঁরই মত অতুলনীয় বীর। এত বিরাট নদী এভাবে সাঁতরিয়ে অতিক্রম করা তাঁদের পক্ষেই সাজে। যদি এই ব্যক্তি জীবিত থাকে তাহলে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, সে একদিন দুনিয়া থেকে মঙ্গোলদের নাম-নিশানা মুছে তবে ক্ষান্ত হবে। অতএব একে হত্যার ব্যাপারে অবশ্যই চিন্তা-ভাবনা করতে হবে। কিন্তু চেঙ্গিস খানের পক্ষে সেদিন সিন্ধু নদের তীরে দাঁড়িয়ে শুধু আক্ষেপ করাটাই সার হলো। সিন্ধু নদ অতিক্রম করা তার বা তার বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হলো না। এটা হচ্ছে ৬২০ হিজরীর (১২২৩ খ্রি) ঘটনা।
যেহেতু জালালুদ্দীনের বীরত্ব বাহাদুরীর খ্যাতি তখন দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল তাই ঈর্ষাবশত কোন রাষ্ট্রনায়কই জালালুদ্দীনের দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করেননি। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে তিনি একাই মঙ্গোলদের মুকাবিলা করার জন্য তৈরি হয়ে যান। ঐ মুহূর্তে জালালুদ্দীন হয়ত মঙ্গোলদের পরাজিত করে মঙ্গোলদের মনে এমনি ভীতির সঞ্চার করতেন যে, তারা পরবর্তী সময়ে ইসলামী সাম্রাজ্যসমূহ আক্রমণ করার সাহস পেত না। কিন্তু এটা আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা ছিল না। তাই দেখা যায়, মঙ্গোল বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য জালালুদ্দীন যে সমস্ত গুপ্তচর নিয়োগ করেছিলেন তারা তাকে এই সংবাদ দিল যে, মঙ্গোল বাহিনী এখনও অনেক দূরে অবস্থান করছে। অথচ মঙ্গোল বাহিনী তখন একেবারে সন্নিকটে এসে গিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত মঙ্গোলরা ঠিক অর্ধেক রাতে অকস্মাৎ এমনভাবে হামলা চালাল যে, তখন শত্রুদের এভাবে আগমনের কথা জালালুদ্দীন কল্পনাও করতে পারেননি। এভাবে তিনি হঠাৎ নিজেকে শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় দেখে বাধ্য হয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। কিন্তু যখন জয়ের কোনই সম্ভাবনা দেখতে পেলেন না তখন প্রবল বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে শত্রুর ঘেরাও থেকে বের হয়ে গেলেন। তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ।
তাঁর সন্ধান আর পাওয়া যায়নি। সুলতান জালালুদ্দীনের পরিণাম সম্পর্কে দু’টি বর্ণনা খুবই বিখ্যাত। একটি বর্ননা এই যে, পলায়নরত অবস্থায় যখন তিনি পাহাড়ের কোন একটি জায়গায় বিশ্রাম গ্রহণ করছিলেন তখন তার ঘোড়া ও পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে কোন একটি পাহাড়ী লোকের ভয়ানক লোভ হয় এবং সে তাঁকে প্রতারণার মাধ্যমে হত্যা করে ফেলে। অপর বর্ণনা এই যে, তিনি তাঁর পোশাক পরিবর্তন করে একজন সূফী ও আবিদ হিসাবে বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। ঐ সময়ে তিনি দূর-দূরান্তের দেশসমূহ সফর করেন। এই সংসার ত্যাগী অবস্থায় তিনি নাকি দীর্ঘদিন বেঁচেছিলেন।
Server 01
Server 02
Server 03
সিরিজটি আপনারা উপভোগ করুন এবং আমরা আরো সিরিজ আপনাদের উপহার দিব।
সবাই বেশি বেশি করে শেয়ার করেন এবং সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। এবং সামর্থ থাকলে ডোনেট করতে পারেনঃ- বিকাশ
I am astounded by the richness of your content.
Your dedication to providing accurate and insightful information is evident in every post. Thank you!