আল্প আরসালান বেগ (১০২৯-১৫ ডিসেম্বর ১০৭২) (ফার্সি:بیگ آلپ ارسلانālp arslān; আরবি: الب ارسلان بیگ alb arslān), আসল নাম মুহাম্মদ বেগ বিন দাউদ চারী, তিনি সেলজুক রাজবংশের তৃতীয় সুলতান এবং সেলজুকের প্রপৌত্র। তার সময় থেকেই সেলজুক বংশ রাজবংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তার সামরিক দক্ষতা, বীরত্ব এবং লড়াইয়ে পারদর্শিতার জন্য তিনি আল্প আরসালান উপাধি লাভ করেন। তুর্কি ও তুর্কমেন ভাষায় এর অর্থ “বীর সিংহ”।
আল্প আরসালানের চরিত্র
ঐতিহাসিক ইবনুল আসীর আলুপ আরসালানকে উদার, মহানুভব, ন্যায়পরায়ণ ও জ্ঞানী শাসক, ধার্মিক, দয়ালু, সানশীল, দরিদ্রের প্রতি সহমর্মী, নিন্দনীয় কার্যকলাপ বিমুখ এবং সর্বোপরি সাহসী বলে বর্ণনা করেছেন। রোম সম্রাটের প্রতি সদয় ব্যবহার তার মহানুভবতার পরিচয় বহন করে। তিনি ন্যায়পরায়ণ এবং প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। মনোবল, ধর্মবল ও বাহুবলে তিনি সমান ছিলেন। দুর্বল আব্বাসি শাসকের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। এশিয়া মাইনরে সুন্নি ইসলামের প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষেত্রে আলুপ আরসালান ছিলেন অগ্রপথিক।
আল্প আরসালানের কৃতিত্ব
মুসলিম প্রাচ্যে গৌরবোজ্জ্বল শাসনের সূচনা:
রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আলুপ আরসালান মুসলিম প্রাচ্যে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেন। পি কে হিট্টি বলেন, তুমিল (১০৩৭-১০৬৩), তার ভ্রাতুষ্পুত্র ও উত্তরাধিকারী আলপ আরসালান (১০৬৩-১০৭২) এবং মালিক শাহের শাসনকাল (১০৭২-১০৯২) মুসলিম প্রাচ্যে সেলজুক উত্থানের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করে।
সাম্রাজ্য সুসংহতকরণ:
আলুপ আরসালানের রাজত্বকালে তুর্কি উপজাতিরা দলে দলে মুসলিম বাহিনীতে যোগদান করলে তার পক্ষে আব্বাসি সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল পুনর্দখল করে একটি সুসংহত রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। এর ফলে মুসলিম সৈন্যবাহিনীর মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। মুসলিম বাহিনী আরও শক্তিশালী এবং অপ্রতিহত হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে মালাজকার্দের যুদ্ধে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।
নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা:
সেলজুক বংশের প্রতিষ্ঠাতা তুমিল পূর্বাঞ্চলের খোরাসান প্রদেশের মার্তে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু এটি রাজ্যের এক প্রান্তে অবস্থিত হওয়ায় বিদ্রোহ দমন ও বাইজান্টাইনদের মোকাবিলায় সমস্যা দেখা দিত। দূরদর্শী প্রশাসক হিসেবে আলপ আরসালান রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ইস্পাহানে রাজধানী স্থানান্তর করেন।
দুর্বল আব্বাসি খলিফার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক:
অতীতে বুয়াইয়া আমিররা দুর্বল আব্বাসি খলিফাদের সার্বভৌমত্বে আঘাত হানলেও সেলজুক সুলতানরা খলিফাদের সাথে শ্রদ্ধা ও ভক্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। আলপ আরসালান ও তার পূর্বসূরি তুগ্রিলের মতোই দুর্বল খলিফা কায়িমের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন।
বাইজান্টাইনদের সাথে সাথে জয়লাভ:
আপন আরসাপানের রাজত্বকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল বাইজান্টাইনদের সাথে সংঘাত ও জয়লাভ। ভূমিলের সময় মুসলমানদের সাথে বাইজান্টাইনদের যে সংঘর্ষের সূচনা হয় আলপ আরসালানের সময় তা চরম আকার ধারণ করে। ভূমিস ১০৬০ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে -তাদেরকে কারাডোর্সিয়া ও জির্জিয়া থেকে বিতাড়িত করেন। তবে এ অ্যালকে স্থায়ীভাবে জয় করেন আলপ আরসালান। এর পর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া জয় করে আজারবাইজানে অবস্থানের সময় খবর পান যে, ডায়াজিনিস রানা (মাস) নামের এক ব্যক্তি সম্রাজ্ঞী ইউভোগিয়ার কল্যাণে বধ্যভূমি থেকে মুক্তি পেয়ে বাইজান্টাইন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি বাগদাদ পশ্চিম এশিয়া রোমকদের পদানত করার উদ্দেশ্যে দু’লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে অকস্মাৎ এশিয়া মাইনর আক্রমণ করেছেন। ঐতিহাসিকদের মতে, কনস্টান্টিনোপল থেকে বিজয়াভিয়ান অথবা পৃষ্ঠনের জন্য ইতোপূর্বে এর চেয়ে বেশি সুসজ্জিত ও বড় সৈন্যবাহিনী বের হয়নি।
মালাজগ্রিট যুদ্ধ ও সন্দি;
বাইজান্টাইনদের আগমনের সংবাদে বিচলিত না হয়ে শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য আলপ আরসালান মাত্র ৪০,০০০ সৈন্য নিয়ে আর্মেনিয়ার দিকে যাত্রা করেন এবং মালাজকার্দে ঘাঁটি স্থাপন করেন। মালাজকার্দ ছিল বর্তমান আজোম এবং ভ্যান নগরদ্বয়ের মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি বিখ্যাত দুর্গ। এখানে উভয় বাহিনী মুখোমুখি হয়। প্রথম দিকে মুসলমান সেনারা শত্রুর সংখ্যাধিক্যে ভীত হয়ে পড়লেও তাদের অদম্য স্পৃহার ফলে অচিরেই বাইজান্টাইনরা শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। সম্রাট রোমানাস বন্দি হন। পি কে হিট্টির মতে, মালাজকার্নে বাইজান্টাইনদের বিপর্যয়ে সেলজুক নেতৃত্বাধীন মুসলমানরা সর্বপ্রথম রোমান সম্রাটের অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয়। এভাবে এশিয়া মাইনরের তুর্কিকরণের প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে আলাপ-আলোচনার পর সুলতান ও রোমানাসের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। এ সন্ধির শর্তানুসারে রোমানাস তার কন্যাদের আপ আরসালানের পুত্রদের সাথে বিবাহ দিতে ও বন্দিত্ব মোচনের জন্য দশ লক্ষ এবং বাৎসরিক রাজস্বস্বরূপ তিন লক্ষ ষাট হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিতে এবং সকল যুদ্ধবন্দি ফেরত দিতে রাজি হন।
যুদ্ধের ফলাফল:
মালাজকার্দের যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এ যুদ্ধে মুসলমানদের জয়লাভের ফলে এশিয়া মাইনরে বাইজান্টাইন প্রভুত্ব হ্রাস পেয়ে সেলজুক প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। আরসালান যুদ্ধজয়ের পর অধিকৃত অখালের শাসনভার পিতৃব্যপুত্র সুলায়মান ইবন কুতলুমিশের হাতে অর্পণ করেন। সুলায়ম বিজ্ঞ শাসক ও সাহসী যোদ্ধা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি রাজ্যসীমা উত্তরে হেলেসপন্ট ও পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত করেন এবং বাইজান্টাইন সম্রাটদের কাছ থেকে কর আদায় করেন। মালাজকার্দের যুদ্ধে মুসলিম বিজয় এশিয়া মাইনরে খ্রিস্টান প্রভৃত্বের সম্ভাবনা দূর করে এবং ইসলামের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটায়। এশিয়া মাইনরের তুর্কিকরণ শুধু ইসলামের রাজ্য এবং ধর্ম বিস্তারেই সহায়ক ছিল না, বরং এর ফলে পরবর্তীকালে অটোমান তুর্কিদের আবির্ভাব সুনিশ্চিত হয়। মালাজকার্দের যুদ্ধ জয়ের ঘটনাকে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয়ের প্রথম পদক্ষেপ বলেও মনে করা হতো।
মৃত্যু
মানযিকার্টের যুদ্ধের পর আল্প আরসালান পশ্চিম এশিয়ার অধিকাংশ অধিকার করেন। এরপর তিনি তার পূর্বপুরুষদের অঞ্চল তুর্কিস্তান অধিকার করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এক শক্তিশালী সেনাবাহিনী নিয়ে তিনি আমু দরিয়ার দিকে যাত্রা করেন। নদী পার হওয়ার আগে কিছু দুর্গ দখল করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তৎমধ্যে একটি বেশ কয়েকদিন ধরে ইউসুফ আল-হারেযমি প্রতিরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি আত্মসমর্পণে বাধ্য হন এবং সুলতানের সামনে তাকে আনা হয়। সুলতান তাকে মৃত্যুদন্ড দেন। ইউসুফ তৎক্ষণাৎ তার বিষাক্ত ছুরি বের করে সুলতানের উপর হামলা চালান। এর চার দিন পর ১০৭২ সালের ২৫ নভেম্ব আরসালান মৃত্যু বরণ করেন। মার্ভে তার পিতা চাঘরাই বেগের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তার সমাধিতে লেখা রয়েছে: “যারা সুলতান আল্প আরসালান বেগ’র আকাশসম জাকজমক দেখেছ, দেখ, তিনি এখন কালো মাটির নিচে শায়িত…”
server 01
server 02
server 03
সিরিজটি আপনারা উপভোগ করুন এবং আমরা আরো সিরিজ আপনাদের উপহার দিব।
সবাই বেশি বেশি করে শেয়ার করেন এবং সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। এবং সামর্থ্য থাকলে ডোনেট করতে পারেনঃ- বিকাশ ও নগদঃ- 01880473953 (পার্সোনাল)।
I appreciate how this blog focuses on providing solutions rather than just discussing problems. It’s a refreshing approach.
Your articles are a deep dive into the subject. Very satisfying.