কুরুলুস উসমান
উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুলতান উসমান প্রথমের জীবনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি তুর্কী ঐতিহাসিক, অ্যাডভেঞ্চার টেলিভিশন সিরিজ। এটি জনপ্রিয় ঐতিহাসিক ফিকশন টিভিসিরিজ দিরিলিস: আরতুগ্রুল-এর সিক্যুয়েল যা উসমানের পিতা আরতুগ্রুলের জীবনকাহিনীকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছিল। কুরুলুস উসমানের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সংগ্রাম এবং তিনি কীভাবে উসমানীয় রাজত্ব প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণ করেন তা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এটি বাইজান্টাইন এবং মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম এবং কীভাবে তিনি বাইজেন্টাইন এবং মঙ্গোল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে এবং তুর্কিদের সম্মান জানাতে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য রুমের স্বাধীনতা সুলতানি ঘোষণা করতে সক্ষম হয়েছিল তা চিত্রিত করে। ওরগুজ তুর্কী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার ব্যক্তিগত জীবন এবং সুলতান প্রতিষ্ঠার তাদের ইতিহাস শুরুর দিকে অন্তর্দৃষ্টি দেয়। ওসমানের চরিত্রটি তার সন্ধানে অনেক শত্রু এবং বিশ্বাসঘাতকদের মুখোমুখি হয়েছিল এবং সিরিজটিতে চিত্রিত হয় যে কীভাবে তিনি এই বাধাগুলি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন এবং তাঁর অনুগত সহচর, পরিবার এবং বন্ধুদের সহায়তায় তাঁর সপ্নকে সম্পাদন করতে পেরেছিলেন।
যারা আগে দিরিলিস আরতুগ্রুল দেখেছেন তারা কুরুলুস উসমান সম্পর্কে আগে থেকে জেনে থাকবেন। উসমান যে কিনা আর্তুগ্রুল এর ছেলে। আমরা সবাই অটোম্যান সাম্রাজ্য নাম সবাই শুনেছি। অটোম্যান সাম্রাজ্য বা উসমানীয় সাম্রাজ্য, যেই সাম্রাজ্য 1299 সাল থেকে 1923 সাল পর্যন্ত প্রায় ৬০০ বছর বিশাল ভুখন্ডে ইসলামী শাসন কায়েম করে। আর এই অটোম্যান সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে উসমান এর হাত ধরে। কুরুলুস উসমান সিরিজে প্রথম থেকে কিভাবে উসমান ধীরে ধীরে তার সাম্রাজ্য গড়ে তোলে তার কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। উসমান থেকেই মূলত অটোমান নামটা এসেছে। আসলে ইংরেজরা উসমান নামটা এভাবে উচ্চারণ করতো না। তারা অটোমান উচ্চারণ করতো। এখান থেকেই মূলত Ottoman Empire বা অটোম্যান সাম্রাজ্য হিসাবেই সবাই জানি।
এখন সিরিজ নিয়ে কিছু বলি। তখন মঙ্গোলরা এশিয়া থেকে শুরু করে ইউরোপের দিক আসে দখল করার জন্য। মাঝে তুরস্ক দখলের চেষ্টা করলে প্রথমে আরতুগ্রুল পরে উসমান মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। প্রথম সিরিজ শেষ হয়েছে ২৭ টা এপিসোড নিয়ে। ২৭ নং এপিসোডের শেষে দেখা যায় মঙ্গোলদের পরাজিত করে। সাথে খ্রিষ্টানদের কাছ থেকে একটা দুর্গ দখল করে। এভাবেই হয়তো শুরু হয় উসমানীয় সাম্রাজ্য। সিরিজে ইসলামী বিশ্বাস ও আল্লাহর উপর সর্বোচ্চ আস্থা রাখার উপর গুরুত্ব দিয়া হয়েছে। নানা রকম ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে কিভাবে উসমান সামনে এগিয়ে যায় তার জন্য দেখুন সিরিজটি।
চলুন আরো বিস্তারিত ভাবে জানি-
আরতগ্রুল উসমান গাজি ছিলেন উসমানীয় তুর্কিদের নেতা এবং উসমানীয় রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। উসমানের সময় উসমানীয়দের রাজ্য আকারে ছোট ছিল এবং পরবর্তীতে তা বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।১৯২২ সালে সালতানাতের বিলুপ্তির পূর্ব পর্যন্ত সাম্রাজ্য টিকে ছিল। জন্ম ১৩ ফেব্রুয়ারি ১২৫৮ সোগুত, আনাতোলিয়া। পিতা-আরতুগ্রুল গাজি, মাতা-হালিমা হাতুন।
একটি প্রচলিত মতানুযায়ী প্রথম উসমানের পিতা এরতুগরুল মোঙ্গলদের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করে তুর্কি কায়ি গোত্রকে মধ্য এশিয়া থেকে আনাতোলিয়া নিয়ে আসেন। উসমান রুম সুলতান প্রথম কায়কোবাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ১২৯৯ সালের ১৭ জানুয়ারি রুম সুলতান তাকে আনাতোলিয়ায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিমে বাইজেন্টাইনদের দিকে সীমানা বৃদ্ধির অনুমতি প্রদান করেছিলেন। সেলজুকদের ভাঙনের পর আনাতোলিয়ায় উদ্ভূত ক্ষুদ্র তুর্কি রাজ্যসমূহের মধ্যে উসমানীয় রাজ্য অন্যতম ছিল। এসকল রাজ্যের মধ্যে উসমানীয়রা অবশেষে আনাতোলিয়াকে তুর্কি শাসনের অধীনে ঐক্যবদ্ধ করে। মোঙ্গলদের পশ্চিমমুখী আগ্রাসনের কারণে অসংখ্য মুসলিম উসমানের রাজ্যে আশ্রয় নেয়। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে উসমানীয় রাজ্য উত্থান হতে থাকে।
পিতার মৃত্যুর পর উসমান প্রধান বা বে হন। এই সময় নাগাদ দুর্বল হয়ে পড়া বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সমগ্র ইসলামি জগত থেকে সৈনিকরা তার শাসনাধীন অঞ্চলে এসে জড়ো হয়। এছাড়াও মোঙ্গলদের হাত থেকে বাঁচার জন্য অসংখ্য উদ্বাস্তু উসমানের আমিরাতে এসে আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে অনেক গাজি ছিল। উসমানের দক্ষ নেতৃত্বে এই যোদ্ধারা দ্রুত কার্যকর বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠে এবং এর ফলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
উসমান গাজি বিখ্যাত শাইখ এদিবালিকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তার মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। তিনি প্রায়ই এদিবালির সাথে সাক্ষাত করতেন।
এক রাতে এদিবালির দরগাতে অবস্থান করার সময় দেখা স্বপ্ন পরের দিন তিনি এদিবালিকে জানান। তিনি বলেন, “আমার শাইখ, স্বপ্নে আমি আপনাকে দেখেছি। একটি চাঁদ আপনার বুকে দেখা দিয়েছে। এটি উঠতে থাকে এবং আমার বুকে এসে অবতীর্ণ হয়। আমার নাভি থেকে একটি গাছ উঠে। এটি বৃদ্ধি পায় এবং শাখাপ্রশাখা এত বেশি হয় যে এর ছায়া পুরো পৃথিবীকে আবৃত করে ফেলে। এই স্বপ্নের অর্থ কী??”
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর এদিবালি ব্যাখ্যা দেন:
“অভিনন্দন উসমান! সর্বশক্তিমান আল্লাহ তোমার এবং তোমার বংশধরদেরকে সার্বভৌমত্ব প্রদান করেছেন। আমার কন্যা তোমার স্ত্রী হবে এবং সমগ্র বিশ্ব তোমার সন্তানদের নিরাপত্তাধীন হবে।”
শাসক হিসেবে উসমানের অবদান
অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় উসমানের নামে। উসমান যেমন একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন তেমনি ছিলেন একজন দক্ষ সৈনিক। সেই সাথে উসমানের চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে জ্ঞান এবং সহিষ্ণুতাও ছিল। উসমানকে তার আশেপাশের ছোট বড় সকলেই শ্রদ্ধা করতেন কারণ তিনি শাসক হিসেবে কারো উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিতেন না। ফলে তার অনুসারীদের মধ্যে কোন সংঘর্ষ ছিলনা, সবার মধ্যে ছিল শুধুই বিশ্বস্ততা। তার অনুসারীরা তার সাথে কাজ করতো এবং তাকে শান্তিপূর্ণভাবে মান্য করতো। আর এভাবেই একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে সামাজিক ঐক্য গড়ে ওঠে এবং রাষ্ট্র স্থায়ীত্ব লাভ করে। এর পাশাপাশি উসমান নিজেদের সেনাবাহিনী গঠন করে নিজেরাই বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করতো। উসমান খলিফা ওসমানের মতাদর্শকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছিলেন এবং খলিফা ওসমানের মতো সম্পদ এবং শক্তির চেয়েও ন্যায় বিচারকে উপরে স্থান দিয়েছিলেন। একই সাথে শাসণ কার্যের উপর ছিল তার ব্যক্তিগত সার্বভৌমত্ব, সে কারণে সেই সময়ের অন্যান্য রাজবংশের মতো অটোমানদের মধ্যে বংশগত কোন দ্বন্দ ছিলনা।
উসমানের প্রতিবেশী গ্রাম এবং দূর্গের অধিকাংশ নেতা ছিলেন খ্রিস্টান এবং তারা এক সময় শত্রু ছিলেন কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় তারা তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। অটোমান ভূখন্ডের মাঝে সব খ্রিস্টানকে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়নি বরং বিপুল সংখ্যক খ্রিস্টান নিজেদের পছন্দে ইসলাম গ্রহণ করে কারণ এ সকল খ্রিস্টান মনে করতো বাইজেন্টাইন শাসকেরা তাদের অবহেলা করছে এবং কনস্টান্টিনোপলে প্রশাসন ক্রম অবনতির দিকে যাচ্ছে। ফলে বাস্তববুদ্ধি বশত তারা সুশৃঙ্খল এবং বিশ্বস্ত উসমানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
এর ফলে মুসলমানদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ খুলে যায় এবং এশীয় গ্রিকরা নতুন বিশ্বাস এবং নতুন শাসনের দিকে ঝুঁকে যায়। অটোমানরা ছিল আদর্শ সমাজের নমুনা যাদের লক্ষ ছিল বাইজেন্টাইনদের মতো হওয়া অর্থ্যাৎ তাদের ক্ষমতা দখন করা যেভাবে সেলজুক তুর্কিরা আরব সাম্রাজ্যের শূণ্যস্থান পূরণ করেছিল।
ধীরস্থির ভাবে রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধি
প্রতিবেশীদের রাজ্যগুলো দখল করে নিজের রাজ্যের সীমানা বাড়ানোর প্রতি উসমানের কোন তাড়াহুড়া ছিলনা। ধীরস্থির চরিত্রের উসমান পরিকল্পনা মাফিক অপেক্ষা করছিলেন সুযোগের। তার মতবাদ ছিল বেঁচে থাকা এবং শেখা আর এভাবেই বাইজেন্টাইন ভূখন্ডে কাজ করা। সেই সময় বাইজেন্টাইনরা তিনটি শহরে শাসণ করতো। দক্ষিণে ছিল বুরসা, মাঝখানে ছিল নিকাইয়া এবং উত্তরে ছিল নিকোমেডিয়া। তিনটি স্থান উসমানের রাজধানী থেকে মাত্র একদিনের পথ দূরত্বে ছিল কিন্তু উসমান প্রথমেই আক্রমণ করেননি।
প্রতিবেশী অঞ্চল সমূহের বেকার সৈন্যদের নিজ দলে টেনে আনেন খুব সহজে কারণ এই সৈন্যরা দীর্ঘদিন ধরে কনস্টান্টিনোপলের কাছে থেকে অবহেলা আর উৎপীড়নের স্বীকার হয়ে আসছিল। চতুর্দশ শতাব্দির প্রথম বছরে ক্ষমতা গ্রহণের ১২বছর পর করুণ হিসারে উসমান বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়ান। নিকোমিডিয়ায় অটোমানরা লুট করা শুরু করে তখন গ্রিক সৈন্যরা তাদের বাধা দিতে এসে সহজেই হেরে যায়। সাধারণ একজন নেতার কাছে রাজ বাহিনী হেরে যাওয়ার কারণে বাইজেন্টাইন শাসকদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয় এবং তারা উসমানের অঞ্চলকে বিবেচনা করতে শুরু করে ফলে উসমানের সুখ্যাতি বেড়ে যায়।
সেই সাথে আশাপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের যোদ্ধারা তার দলে যোগ দেয় এবং গর্বভরে উসমানের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু। কিন্ত উসমান এতে উৎসাহী নিকোমিডিয়াতে কোন আক্রমণ না করে অপেক্ষা করতে থাকেন আরও একটি সুযোগের। সাত বছর পর যখন তিনি নিজেকে যথেষ্ঠ শক্তিশালী ভাবছিলেন তখন তিনি নিকোমিয়ার পিছনে সার্কাযা নদীতে আক্রমণ করেন এবং বিজয়ী হিসেবে প্রথমবারের মতো বসফরাসে প্রবেশ করেন। ধীরে ধীরে এর পূর্বে কৃষ্ণসাগরের বিভিন্ন সমুদ্রবন্দর ও দূর্গ দখল করে নিতে থাকেন এবং বুরসা ও নিকোমিডিয়ার মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্থ করে দেন।
সমুদ্রপথে এই দুই শহরের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তিনি স্থলপথে বুরসাতে আক্রমণ করেন এবং ১৩২৬ সালে সেটি নিজের অধিকারে নেন এবং উসমান মৃত্যুবরণ করেন। অধিকৃত বুরসায় অটোমানদের প্রথম রাজধানী স্থাপন করা হয় এবং উসমানের ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে বুরসাতে সমাহিত করা হয়।
সিরিজটি আপনারা উপভোগ করুন এবং আমরা আরো সিরিজ আপনাদের উপহার দিব।
সবাই বেশি বেশি করে শেয়ার করেন এবং সবাইকে দেখার সুযোগ করে দিন। এবং সামর্থ থাকলে ডোনেট করতে পারেনঃ- বিকাশ ও নগদঃ- 01880473953 (পার্সোনাল)।